Saturday 9 July 2011

ফরেন পলিসি' ম্যাগাজিনের রিপোর্ট ভারত-দুর্গের জন্য বাংলাদেশ ঘিরে দিল্লীর বার্লিন প্রাচীর

শাহেদ মতিউর রহমান : বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত এখন ক্রমেই বিশ্বের অন্যতম রক্তঝরা একটি সীমান্তাঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সীমান্তবিষয়ক জটিলতার সংবাদ শিরোনাম হলেও সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু ঘটনা প্রবাহ এবং বাংলাদেশ ও ভারতের এই সীমান্তের হত্যাকান্ড নিয়ে বেশ উদ্বেগেরও সৃষ্টি করেছে। সূত্রে প্রকাশ গত এক দশকে দু'দেশের এক হাজার ৭৯০ মাইল দীর্ঘ এই সীমান্ত ঘিরে প্রায় এক হাজার নিরপরাধ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ভারত তার ২৫ সালা সীমান্ত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজটিও প্রায় সম্পন্ন করেছে। আগামী বছরের মধেই এর পুরো কাজটি তারা শেষ করতে চাইছে। তবে এত বড় একটি সীমানা ঘিরে ভারতের বেড়া নির্মাণের পরেও সীমান্তের এই হত্যাকান্ডের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। অনেকে আজ প্রশ্ন তুলেছেন তাহলে কী ভারত-দুর্গের জন্য বাংলাদেশ ঘিরে দিল্লীর কোন বার্লিন প্রাচীর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেন পলিসি তাদের ২০১১ এর জুলাই-আগস্ট সংখ্যায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে নির্বিচারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের ওপরে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। স্কট কার্নি, জ্যাসন মিকলেইন ও ক্রিসটেইন হোলসারের সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ফেলানী হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে তুলে ধরা হয়েছে গত এক দশকের সীমান্ত হত্যার লোমহর্ষক নানা কাহিনী।
ম্যাগাজিনের ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে সীমান্তে বেড়া নির্মাণকে ভারতীয়রা তাদের জন্য একটি সর্বরোগ হরণকারী প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচনা করছে। তাদের বিবেচনায় এই বেড়া নির্মাণের ফলে মুসলিম জঙ্গিবাদ ও কাজের সন্ধানে বেআইনিভাবে ভারতে প্রবেশকারী বিদেশীদের আটকানো সহজ হবে। কিন্তু তার পরেও সীমান্তে যেভাবে হত্যাকান্ড চলছে তা বিশ্ব বিবেকের দরজায় আজ কড়া নাড়ছে।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ভারতের এই নির্বিচার হত্যাকান্ড বন্ধ করতে ভারতের উচ্চ পর্যায়ে বার বার আবেদন নিবেদন জানানোর পরেও কিন্তু এই হত্যাকান্ড বন্ধ হচ্ছে না। তবে তারা অনেক সময়েই আমাদেরকে এই বলে ওয়াদা দিয়েছে ও আশ্বস্ত করেছে যে তারা আর কোন হত্যাকান্ড ঘটাবে না কিংবা সীমান্তে তারা কোন ভারী অস্ত্রও আর ব্যবহার করবে না। কিন্তু কখনোই তারা বাস্তবে তাদের সেই কথা কিন্তু রাখেনি।
উপরন্তু ভারতের কর্তা ব্যক্তিরা বাংলাদেশীদের বিভিন্নভাবে অপরাধী সাজিয়ে এই হত্যাকান্ড অব্যাহত রেখেছে। এদিকে ভারতের মানবাধিকার সংগঠন ‘মাসুম' এর প্রধান কর্মকর্তা কিরিটি রায় বলেছেন সাধারণত সীমান্তের লাইন ম্যানের সাথে অর্থ লেনদেন ছাড়া কেউই বেড়া পারাপারের জন্য ঝুঁকি নেন না। তারা বিএসএফকে ঘুষ দিয়ে অন্যমনস্ক করে অবৈধ অভিভাসীদের সীমান্ত পারাপারে সহায়তার এই কাজটি করে থাকে। ভারতের এই মানবাধিকার সংগঠনটি গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের অধিকার ও হিউম্যান রাইটস এর সাথে যৌথ উদ্যোগে সীমান্ত হত্যাকান্ড ও সমসাময়িক বিষয়ে একটি জরিপ কাজ পরিচালনা করে তাদের গবেষণা প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। ঐ প্রতিবেদনে মাসুম এর প্রধান কিরিটি বলেন, সীমান্তে ঘুষ প্রথার কারণেই সেখানে এই হত্যাকান্ড বেশি ঘটে। ঘুষ না দিয়ে যদি কেউ সীমান্ত পার হতে চেষ্টা করে তাহলে লাইনম্যানরা বিষয়টি অস্ত্রধারী বিএসএফকে জানিয়ে দেয় এবং গুলী চালাতে উৎসাহিত করে।
সীমান্তে এই হত্যাকান্ডকে বৈধতা দেয়ার জন্য ভারতীয়রা বরাবরই নানা যুক্তি তুলে ধরে আসছে। তারা অনেক সময় বলে বেড়ায় নেহায়েত আত্মরক্ষার জন্যই সীমান্তরক্ষীরা গুলী চালাতে বাধ্য হয়। নচেৎ তারা কখনো গুলী করে না। তবে ভারতীয় এই কর্তা ব্যক্তিদের বক্তব্য যে কতটা মিথ্যাচার আর সত্যের অপলাপ তার প্রমাণও পাওয়া যায় মাসুম অধিকার ও হিউম্যান রাটস'র পরিচালিত জরিপের ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে। তিনটি সংস্থার যৌথভাবে পরিচালিত ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত এক দশকে সীমান্তে নিহত হয়েছে এমন একজনেরও পরিচয় পাওয়া যায়নি যিনি সীমান্ত পার হতে গিয়ে কোন অস্ত্র বহন করেছেন। প্রতিবেদনে এই তথ্যটিই এসেছে যে বড়জোর তার হাতে হয়তো একটি লাঠি বা কাস্তে ছিল। সংগঠন তিনটি সীমান্তে নিরীহ মানুষের ওপরে বিএসএফ'র বিরুদ্ধে নির্যাতন চালানোরও অভিযোগ উত্থাপন করেছেন।

http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=57059

সীমান্তে বিএসএফ যেভাবে বাংলাদেশী হত্যা করছে

অলিউল্লাহ নোমান
নানা কৌশলে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করছে বিএসএফ। বন্দুকের গুলির পাশাপাশি পাথর নিক্ষেপ করে এবং পিটিয়েও বাংলাদেশী হত্যা করা হচ্ছে। সীমান্তে পাখির মতো মানুষ হত্যা করছে বিএসএফ। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন ও মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কা করছে না তারা। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের সীমান্তে এত মানুষ খুন হয় না। শুধু খুন নয় ভূমি দখলেও মরিয়া ভারত।চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফের হাতে ১৭ জন বাংলাদেশী নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। এর বাইরে চলতি মাসের প্রথম ৬ দিনে আরও ২ জন বাংলাদেশীকে বিএসএফ হত্যা করেছে। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বিএসএফের নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়েছেন আরও ৪৯ জন বাংলাদেশী নাগরিক। অপহরণ করা হয়েছে ৫ জনকে। সর্বশেষ গত ২ জুলাই সিলেটের ভোলাগঞ্জ সীমান্তে এক যুবককে গুলি করে এবং ৩০ জুন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে এক যুবককে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। ভারত বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা করবে না বলে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও রক্ষা করছে না। গত ২৪ মার্চ জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৬ মাসে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ১৩৬ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১৭০ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালেও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে আগের বছরগুলোর মতোই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। মানুষ খুন হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে এমনকি বিষাক্ত ইনজেকশনও দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশীদের। গত ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তের ৯৪৭ আন্তর্জাতিক সীমানা পিলারের কাছ দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় ফেলানী খাতুন (১৫) নামে এক কিশোরীকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে। পাঁচ ঘণ্টা তার লাশ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলন্ত অবস্থায় রাখার পর ভারতে নিয়ে যায়। ত্রিশ ঘণ্টা পর বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের কাছে ফেলানীর লাশ হস্তান্তর করে বিএসএফ। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫ দিনব্যাপী বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিএসএফের মহাপরিচালক রমন শ্রীবাস্তব বলেন, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে স্পর্শকাতর কিছু স্থানে প্রাণঘাতী নয়, এমন আগ্নেয়াস্ত্র দেয়া হবে। এটি পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত। এতে সফল হলে দুই দেশের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্তে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। বিএসএফ মহাপরিচালকের এই বক্তব্যের পর গত ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার গাজীপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বসন্তপুর গ্রামের মনসুর আলীর ছেলে রেকাতুল ইসলাম (১৭) নিহত হয়। গত ৭ মে দিনাজপুর সদর উপজেলার খানপুর গ্রামের ফয়জুর রহমানের ছেলে হাফিজুর রহমানকে (৩০) সুন্দরা বিওপির প্রধান পিলার ৩১৬-এর সাব পিলার-৪ এর বিপরীতে বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া বিএসএফ নির্যাতনের নতুন পদ্ধতি হিসেবে বাংলাদেশীদের শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে পেট্রল ঢুকিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ১৬ জুন যশোর জেলার শার্শা উপজেলার ধান্যখোলা গ্রামের শাহীন, শরিফুল ইসলাম ও মুলফিক্কারকে বিএসএফ আটক করে হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাদের শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে পেট্রল ঢুকিয়ে দেয়। এদিকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৮৩৮ নম্বর মেইন পিলারের কাছে মিজানুর রহমান নামে ২৮ বছরের এক যুবককে ২৮ জুন পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। ভারতের ১০৪ বিএসএফের বিএসবাড়ি ক্যাম্পের টহল সদস্যদের ছোড়া গুলিতে মিজানুর রহমান নিহত হয়। বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরেই তাকে পাথর ছোড়া হয়। সীমান্তে বিএসএফের এই আক্রমণের ভয়ে এখন কৃষকরা চাষাবাদ করতেও ভয় পায়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করলেও গুলি করে বা পিটিয়ে হত্যার বিধান পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। সীমান্ত অতিক্রম করলে প্রত্যেক দেশেই পাসপোর্ট আইনে মামলা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ভারত এই বিধানের তোয়াক্কা করে না। বাংলাদেশী নাগরিককে সীমান্তের কাছাকাছি দেখলেই গুলি করছে। রাতে কোনো কোনো সীমান্তে কারফিউ জারি থাকে।