Tuesday 17 August 2010

ভারতকে ট্রানজিট দিতে অসম্ভব দ্রুততায় প্রকল্প অনুমোদন : বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন

জাহেদ চৌধুরী
ভারতকে সড়ক, রেল, নৌপথে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নিশ্চিত করতে খুবই দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদন করছে সরকার। গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ৫০ দফা সমঝোতা স্মারকের আলোকে শিগগিরই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করবে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এ লক্ষ্যে শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসবেন। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের একশ’ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের স্বাক্ষরিত এই ঋণচুক্তির শর্ত এবং উদ্দেশ্য নিয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের এক্সিম ব্যাংকের নিজস্ব ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ভারত সরকারের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষা করেই এরা বিভিন্ন দেশকে ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণচুক্তির মাধ্যমে যে টাকা ধার হিসেবে পাওয়া যাবে তা চড়া সুদ ও কঠিন শর্তে মূলত ভারতের ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতেই ব্যবহৃত হবে। প্রণব মুখার্জির সফরের সময়ই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তার সফরের আগেই বাংলাদেশ ট্রানজিট সুবিধার কাজটি এগিয়ে নিতে চায়।
ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের দশ দিনেই মধ্যেই গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের বৈঠকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ভারত সংশ্লিষ্ট প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নৌপথ ড্রেজিংয়ের জন্য প্রায় ২১শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬টি ড্রেজার কেনা এবং ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানির লক্ষ্যে বিদ্যুত্ সঞ্চালন লাইন স্থাপনের জন্য এক হাজার ৭৯ কোটি টাকার প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত এসব ড্রেজার সংগ্রহ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান পরিকল্পনা সচিব হাবিব উল্লাহ মজুমদার। এর আগেই প্রণব মুখার্জির সফর শেষ হওয়ার চারদিনের মাথায় গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বেনাপোল স্থলবন্দর এবং শুক্রবার মংলা সমুদ্রবন্দর পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরকালে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতকে তাদের পণ্য নিজ দেশে নিয়ে যেতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। ভারত চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর আমদানি-রফতানির জন্য নিজ দেশে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছে। এজন্য ত্রিপুরার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত সাবব্রুম পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং একইসঙ্গে সাবব্রুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজও চলছে। বাংলাদেশ এই রুটে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের অনুমতি সে দেশকে দিয়েছে। এ সেতু নির্মিত হলে সাবব্রুমের সঙ্গে রামগড়ের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। সাবব্রুম থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৭৫ কিলোমিটার। এদিকে আখাউড়ায় পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে। ভারত তাদের ওডিসি (পণ্যবাহী বড় আকারে কন্টেইনার) পরিবহনের জন্য এ বন্দর ব্যবহার করবে।
এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি দিল্লি সফরে গেলে ভারতের ত্রিপুরার পালাতানায় ৭২৬ মেগাওয়াটের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে আশুগঞ্জ নদীবন্দর হয়ে ওডিসি পরিবহনের জন্য আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বাংলাদেশের সম্মতির কথা জানান। এজন্য আশুগঞ্জ নদীবন্দরকে ‘পোর্ট অব কল’ ঘোষণাসহ প্রয়োজনীয় অনুমোদন দেয়া হলেও বাংলাদেশের অবকাঠামো এখনও ওডিসি পরিবহনের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়নি। ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল এরই মধ্যে দু’দফায় আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সড়ক সরেজমিন পরিদর্শন করে অবকাঠামো উন্নয়নের বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করেছে। বিদ্যুত্ কেন্দ্রের জন্য ভারত প্রায় ১০০টি ওডিসি বার্জে করে আশুগঞ্জ নৌবন্দরে আনবে। সেখান থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সড়কপথে আখাউড়ায় নেয়া হবে। আখাউড়া থেকে রেলযোগে ত্রিপুরার পালাতানায় নেয়া হবে। এজন্য আখাউড়া জংশনে দুই কিলোমিটার আগে বা পরে ত্রিপুরা সীমান্তের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলছে। ওডিসিগুলোর বেশিরভাগই ওজন ১০০ থেকে ২০০ টনের মধ্যে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৫২ টনের দুটি যন্ত্র রয়েছে। এ দুটি লম্বায় ৩০ মিটার, পাশে ৬ মিটার ও উচ্চতায় ৮ মিটার। বাংলাদেশের রাস্তায় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১৯ মিটার বা ৪০ ফুট কন্টেইনার নিয়ে ট্রেলার চলাচল করে। তাও আবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত রাস্তায়। ওডিসি পরিবহনে সময়ের প্রয়োজন হবে এক থেকে দেড় বছর।
ওদিকে বিদ্যুতের আন্তঃদেশীয় গ্রিড লাইন স্থাপন প্রকল্পের অধীন বাংলাদেশ অংশে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ও ভারত অংশে আরও প্রায় ৮০ কিলোমিটার গ্রিড লাইন স্থাপন করতে হবে। পুরো খরচ বাংলাদেশকেই বহন করতে হবে। ভারতীয় অংশের গ্রিড লাইন স্থাপনের টাকাটি বাংলাদেশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাজ থেকে ঋণ নিয়ে করছে। অর্থাত্ বাংলাদেশী টাকায় ভারতের ভেতর গ্রিড লাইন স্থাপন হবে। এ রকম অভূতপূর্ব শর্তের গ্রিড লাইন স্থাপন নিয়ে সাবেক উপদেষ্টা ও কেবিনেট সচিব আকবর আলি খান প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, এই আড়াইশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানির কথা বলে এ ধরনের ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণের কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এ টাকা দিয়ে প্রায় দেড়শ’ মেগাওয়াটের বিদ্যুত্ প্লান্ট বাংলাদেশের ভেতরেই এই সময়ের মধ্যে স্থাপন করা যেত। ভারতের কাছ থেকে এক দশমিক ৭৫ ভাগ সুদ ও দশমিক ৫০ ভাগ কমিটমেন্ট সুদে নেয়া ঋণের টাকায় এরই মধ্যে চিহ্নিত ১৪টি ছোট-বড় প্রকল্পের বাংলাদেশী স্বার্থ নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। ড. আকবর আলি খান বলেছেন, এর মধ্যে প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে আশুগঞ্জে স্থাপিতব্য টার্মিনাল, প্রায় ২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া হয়ে ভারত পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার, সাবব্রুম-রামগড় সড়ক সংস্কারে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ের কোনো প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের নেই। এগুলো স্রেফ ভারতের কাজে লাগে। এসব বন্দর ও সড়ক দিয়ে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না।
ভারতের ত্রিপুরায় বিদ্যুত্ প্রকল্প নির্মাণে বাংলাদেশের আশুগঞ্জ বন্দর দিয়ে এক একটি ২শ’ টন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওজনের বড় আকারের ওডিসি কনটেইনার পরিবহন নিশ্চিত করতে হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলতে হবে। ওডিসি পরিবহনের সময় এ সড়ক দিয়ে অন্য যান চলাচল করতে পারবে না। বাংলাদেশের রাস্তায় যেখানে ৫ থেকে ২০ টন ওজনের কনটেইনার পরিবাহিত হয়ে থাকে, সেখানে এত বড় আকারের কনটেইনার পরিবহনে সড়কের বর্তমান অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বাংলাদেশ যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তার বিপরীতে বাংলাদেশ খুব সামান্যই শুল্ক পাবে। আর্থিক দিকটি নিশ্চিত না করেই বাংলাদেশ ভারতকে এ জাতীয় সুবিধা প্রদানে রাজি হয়েছে।
ভারতীয় ঋণের টাকায় ৬টি ড্রেজার কেনা ও হাজার কোটি টাকার বিদ্যুত্ গ্রিড প্রকল্প একনেকে অনুমোদন : ভারতের দেয়া ঋণের অর্থে প্রথম প্রকল্প অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পের আওতায় দেশের নদী খননের জন্য ৬টি ড্রেজার কিনতে ভারতীয় ঋণের ৪৭২ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। গতকাল শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেক সভায় এ সংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। সভাশেষে পরিকল্পনা সচিব হাবিবুল্লাহ মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জন্য ৬টি ড্রেজার কিনতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ সহায়তার বাইরে ১৬৭ কোটি টাকার জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। ড্রেজারগুলোর মধ্যে একটি মংলা বন্দরের জন্য, তিনটি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং দুটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের জন্য।
পরিকল্পনা সচিব জানান, ২০১২ সালের জুলাইয়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। তবে ড্রেজারগুলো কোন কোন নদীর খনন কাজে ব্যবহার করা হবে, তা জানাতে পারেননি তিনি।
গত ৭ আগস্ট ভারতের সঙ্গে একশ’ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। এই চুক্তি সইয়ের ১০ দিনের মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিবুল্লাহ মজুমদার বলেন, ঋণ সহায়তার বিষয়ে চূড়ান্ত চুক্তির আগেই প্রকল্প প্রস্তুতের জন্য সময় পাওয়া গিয়েছিল।
গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বাংলাদেশকে একশ’ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেয় ভারত।
এছাড়া একনেক সভায় ভারত থেকে বিদ্যুত্ আমদানির লক্ষ্যে ৩০ কিলোমিটার গ্রিড ইন্টারকানেকশন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য এক হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ৭শ’ কোটি টাকা দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ৩৭৯ কোটি টাকার জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। হাবিবুল্লাহ মজুমদার বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের ভেড়ামারা থেকে ভারতের বহরমপুর সীমান্ত পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার ৪০০ কেভি গ্রিড সংযোগ লাইন নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রথম বছরে ২৫০ মেগাওয়াট এবং পরের ৩৪ বছর ৫০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুত্ আদান-প্রদান করা যাবে। ২০১২ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরই বিদ্যুত্ আদান-প্রদান করা যাবে বলে জানান তিনি।
এছাড়া দেশে গ্যাস সঙ্কট মেটাতে ৫টি নতুন কূপ খনন ও ১টি কূপ মেরামতের জন্য ৭৬৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে একনেকে।
অনুমোদন পাওয়া অন্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাজুরিয়া- গান্ধাসুর- সাতপাড়- পাতিয়ারা- রামদিয়া (রামদিয়াবাজার বাইপাসসহ) সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, ২৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচুড়িয়া -ফরিদপুর - ভাঙ্গা রেলপথ পুনর্বাসন ও নির্মাণ প্রকল্প এবং ৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে গোয়ালন্দ- ফরিদপুর- তাড়াইল সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/08/18/39744

Monday 16 August 2010

আওয়ামী লীগের বেপরোয়া এমপিরা

মির্জা মেহেদী তমাল
ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন শাসকদলের কিছু সংসদ সদস্য। সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। শুধু তাই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষকদেরও তারা রেহাই দিচ্ছেন না। মারধর করছেন প্রকাশ্যে। কোনো কোনো স্থানে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক এমপি। দলের একাধিক এমপি এভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় সরকারের নীতিনির্ধারকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

বিশেষ করে নুরুন্নবী শাওন এমপির বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারে খুনের ঘটনা ঘটায় বিষয়টি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। সূত্রে জানা গেছে, খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে দল এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন পদাধিকারীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের এমনও বলেছেন, '৯৬ এর সরকারে কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির বেপরোয়া আচরণের চরম মূল্য গোটা দলকে দিতে হয়েছিল। এমনটি ভবিষ্যতে হোক তিনি চান না। এ জন্য অবিলম্বে অসংযত আচরণকারী এমপিদের লাগাম টেনে ধরতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ দিকে সরকারি দলের এমপিদের কার্যক্রম নিয়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাকেও প্রতিবেদন দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ঘনিষ্ঠসূত্র জানায়, বিতর্কিতদের দায়দায়িত্ব যাতে দলের ওপরে না আসে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে ইতোমধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। পাশাপাশি দলীয়ভাবেও বিতর্ক সৃষ্টিকারী সংসদ সদস্যদের একটি তালিকা করতে তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে বেপরোয়া এমপিদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী কঠোর অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভোলা-৩ আসনের এমপি ও যুবলীগ নেতা নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। খোদ রাজধানীর শেরেবাংলা নগর সংসদ ভবন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবলীগ কর্মী ইব্রাহীমের মৃত্যুর ঘটনায় তার দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ছেন অনেকেই। পুলিশ ইতোমধ্যে তার অস্ত্র ও জিপ গাড়ি জব্দ করেছে। এ দিকে ৩০ জুন আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে আশুলিয়া বাজারসংলগ্ন সেতুর কাছে কর্তব্য পালনের সময় মো. ইলিয়াসউদ্দিন মোল্লাহ এমপি সাভারের ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. শরীফুল ইসলামকে মারধর করেন। এ ঘটনায় সার্জেন্ট শরীফুল ইসলাম ইলিয়াসউদ্দিন মোল্লাহর বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। ঢাকা-৪ আসনের এমপি সানজিদা খানমের বিরুদ্ধে রাস্তার উন্নয়নকাজ বন্ধ রেখে চঁাঁদা দাবির অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর দয়াগঞ্জের একটি সড়কের উন্নয়ন নিয়ে চাঁদা দাবি ঘটনা থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরীর বিরুদ্ধে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি নিয়ে দুর্নীতি ছাড়াও সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কথা বলায় ভাইস চেয়ারম্যান ফাতেমা মনিরকে মারধর পর্যন্ত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে সারাহ বেগম কবরী বলেন, 'আমি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। আমার দ্বারা কাউকে মারধর সম্ভব?' এ দিকে যশোর-১ আসনের সরকারদলীয় এমপি শেখ আফিলউদ্দিন রবিবার শার্শা থানার ওসিকে পিটিয়েছেন। যুবদল নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ায় ক্ষুব্ধ আফিলউদ্দিন এ ঘটনা ঘটান। তাকে মারধরের সময় থানার কয়েকজন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে আফিলউদ্দিন এমপি বলেন, ওসি তার নিজের অপকর্ম ঢাকতে আমার সম্পর্কে কুৎসা রটাচ্ছেন। মারধরের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

দিনাজপুর-৬ আসনের এমপি মো. আজিজুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভিজিএফ কার্ড বিতরণে হস্তক্ষেপ, কর্মীদের মারধর, অসহযোগিতা, দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। গত বছর অক্টোবরে ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের উপস্থিতিতে সংসদ সদস্য মো. আজিজুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়র। নবাবগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শাহ আলমগীর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান অভিযোগ করেছিলেন, আজিজুল হক চৌধুরী এমপির নেতৃত্বে এলাকায় ভিজিএফ, কাবিখাসহ বিভিন্ন সরকারি কাজে লুটপাট চলছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের আবদুল ওদুদ এমপি ও তার সহযোগী মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগে মামলা হয়েছে। চলতি বছরের ৯ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতে এ মামলা করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আতাউর রহমান এবং স্থানীয় হাবিবুর রহমান ও মো. আলাউদ্দীন। এ দিকে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর ভোর ছয়টা থেকে কঙ্বাজার শহরের প্রবেশমুখ কলাতলীতে পুলিশ গাড়ি তল্লাশি করছিল। বেলা ১২টার দিকে সরকারি দলের এমপি এম এ লতিফ ওই তল্লাশি থেকে ২০ গজ দূরে তার গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট আবদুল আজিজ ও পরে হাবিলদার শামসুল আলমকে ডেকে পাঠান। পুলিশ অভিযোগ করে, লতিফ এমপি ওই দুজনকে তুই-তুকারি করে তল্লাশির কারণ জানতে চান। নিজেকে সরকারি দলের এমপি পরিচয় দিয়ে তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এ ছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে এসে ফুল দিতে গিয়েও পুলিশকে মারধর করেন চট্টগ্রামের আলোচিত এই এমপি।

কঙ্বাজার-টেকনাফ সড়কের কুতুপালং উচ্চবিদ্যালয়সংলগ্ন একটি বিকল সড়ক মেরামত ও ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে ১৬ জুন আবদুর রহমান বদি এমপি নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিমকে মারধর করেন। এর প্রতিবাদে কঙ্বাজার ঠিকাদার কল্যাণ সমিতি জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়ক, সেতু ও কালভার্টের নির্মাণকাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখে। ২৩ জুন এক সমঝোতা বৈঠকে নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিমকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চান এমপি আবদুর রহমান বদি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে একাই ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটির সভাপতি হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ ও সদরের আংশিক) আসনের সরকারদলীয় এমপি আবদুল মান্নান। অথচ সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী একজন এমপি তার নির্বাচনী এলাকায় সর্বোচ্চ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারেন। এ ব্যাপারে মার্চের প্রথম সপ্তাহে যশোর শিক্ষা বোর্ডে লিখিত অভিযোগও করেছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম। কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারী) আসনের ক্ষমতাসীন দলের এমপি মো. জাকির হোসেন ৬ জানুয়ারি রৌমারী ভূমি অফিসের কর্মচারী মোশাররফ হোসেনকে মারধর করেন। অফিস সহকারী পদে পছন্দমতো প্রার্থীকে নির্বাচিত না করায় সুনামগঞ্জের জয়শ্রী উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সভাপতি এবং জয়শ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্কাছ উদ্দিন আহমেদকে মারধর করেছেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। শুধু তাই নয়, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও এমপির মারধরের হাত থেকে রক্ষা পাননি। দলীয় এমপিদের বেপরোয়া আচরণের বিষয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে নিশ্চয়ই দল বিষয়টি দেখবে। তিনি বলেন, দলের ভাবমূর্তি সবার আগে। কারো আচরণ যদি দলের জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে তিনি যত ক্ষমতাধরই হোন না কেন পার পাবেন না।

http://bangladesh-pratidin.com/